সিলেট: আর গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়ায় থাকতে চায় না সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। গত ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে শুরু হওয়া ভর্তি প্রক্রিয়ায় যুক্ত হওয়ার পর দীর্ঘ ভর্তি প্রক্রিয়া, মেধাবীদের ভর্তিতে অনাগ্রহ, ফাঁকা আসন নিয়ে ক্লাস শুরু, স্বকীয়তা হারানোসহ নানামুখি সমস্যার কথা তুলে এ পদ্ধতি থেকে বের হতে চায় শাবিপ্রবি প্রশাসন।
তারা বলছে, গুচ্ছের প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত শিক্ষার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে হতে পারে না। কারণ, এটি প্রযুক্তিভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়। আগে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রশ্নপত্র তৈরি হত। গুচ্ছ পদ্ধতিতে সে মান বজায় থাকছে না। যেটি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রত্যাশিত মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী পাওয়া থেকে বঞ্চিত করছে বলে জানান বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী।
গুচ্ছ ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এম সরওয়ার উদ্দিন চৌধুরী বলছিলেন, “গুচ্ছের সিকিউরিটিসহ নানা লিমিটেশনগুলো মাথায় রেখে অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলে সর্বসম্মতিক্রমে আমরা গুচ্ছে না থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং সেটা আমরা শিক্ষা উপদেষ্টাকে জানিয়েছি। এখন তাদের বাকি পদক্ষেপের অপেক্ষায় আছি আমরা।”
কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে ভর্তিচ্ছুদের দুর্ভোগ এড়াতে ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষ থেকে গুচ্ছ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া শুরু হয়। শুরুতে ১৯টি সাধারণ এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এ পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়ার সিদ্ধান্তে আসে। পরে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ গুচ্ছে অংশ নেয়। তবে ঢাকা, জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শুরু থেকেই এ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তির বাইরে ছিল। আর ২০২৩ সালে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি প্রতিষ্ঠানটির ‘স্বকীয়তা’ ধরে রাখতে ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে এককভাবে শিক্ষার্থী ভর্তির দাবি তোলে এবং ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে তারা এ প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসে।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বলছেন, গুচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মূলত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লাভবান হচ্ছে। বিপরীতে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মত উঁচু মানের বিদ্যাপীঠগুলোতে তাদের শিক্ষার মানকে বিসর্জন দিতে হচ্ছে। ফলে গুচ্ছ পদ্ধতিতে শিক্ষার্থী ভর্তির পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। শিক্ষকের মতে, উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, গুচ্ছের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীরা বেশি চান্স পাচ্ছেন। মেডিকেল কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার মত গুচ্ছে দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়া শিক্ষার্থীদের মোট নম্বর থেকে কোনো নম্বরও কাটা হচ্ছে না। এতে প্রথমবার পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
গুচ্ছে যুক্ত হওয়ার পর আসন ফাঁকা রেখে ক্লাস শুরুর বিষয়ে ভর্তি কমিটির সদস্যসচিব অধ্যাপক আবু সাঈদ আরেফিন খাঁন বলেন, “গত ৩ নভেম্বর ৮০টি আসন ফাঁকা রেখে আমাদের ক্লাস শুরু করতে হয়েছে। পরবর্তীতে ভর্তি বাতিল করে গুচ্ছভুক্ত কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কিছু শিক্ষার্থী চলে যায়। এতে এখন আসন ফাঁকা আছে ১০৫টি। “তবে এটি প্রতিদিন বাড়তে-কমতে পারে। কারণ, নিয়মিত কেউ না কেউ ভর্তি বাতিল করছে। আবার নতুন করে ডাকার সাপেক্ষে ওয়েটিং লিস্টে এগিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের ভর্তি করানো হচ্ছে। গুচ্ছ কমিটির নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ডিসেম্বরের ৩ তারিখ পর্যন্ত শিক্ষার্থী ভর্তি নিতে পারব। এর মধ্যে ফাঁকা আসন যা পূরণ করা যায়।”
“আগের প্রশ্নের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আমরা যেসব কোয়ালিটি যাচাই করতে চাইতাম, গুচ্ছের প্রশ্নে শিক্ষার্থীদের সেসব কোয়ালিটি শতভাগ যাচাই করা সম্ভব হচ্ছে না।”
অন্যদিকে, গুচ্ছ প্রক্রিয়ার জটিলতায় ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ১৬২টি আসন ফাঁকা রেখে ক্লাস কার্যক্রম শুরু করতে হয় বলে জানান ওই বর্ষের ভর্তি কমিটির সদস্যসচিব অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল হাকিম। এর আগে ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে গণবিজ্ঞপ্তি দেওয়ার পরও ১০৮টি আসন ফাঁকা রেখে ক্লাস কার্যক্রম শুরু করতে হয়। অথচ গুচ্ছ পূর্ব অবস্থায় একবারও আসন ফাঁকা রাখতে হয়নি বলে জানান শিক্ষকরা।
অধ্যাপক মাহবুবুল হাকিম বলেন, “স্বতন্ত্র ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার সময় আমরা যে মানের শিক্ষার্থী পেতাম, গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় সে মানের শিক্ষার্থী পাচ্ছি না। ক্লাস-পরীক্ষা নিতে গেলে সে পার্থক্য বুঝতে পারি। তবে আগের মতো মানের শিক্ষার্থী না পাওয়ার পেছনে আরও কিছু কারণ থাকতে পারে।
“গুচ্ছ থেকে যেসব শিক্ষার্থী পাচ্ছি, তারা কিন্তু কোভিড-১৯, অটোপাশ, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দেওয়া ইত্যাদি প্রক্রিয়া পার করে আসছে। স্কুল-কলেজে অনেক সময় পরীক্ষার পরিবর্তে শুধুমাত্র অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে ক্লাস পার করেছে। এসব শিক্ষার্থী স্কুল-কলেজে যথাযথ ক্লাসের সুবিধাও পায়নি। এতে তারা অ্যাকাডেমিক জায়গা থেকে কিছুটা দূরে ছিল। এসব কারণগুলোও মানসম্মত শিক্ষার্থী না পাওয়ার পিছনে দায়ী থাকতে পারে।”
থিয়েটার সাস্টের সভাপতি পলাশ বখতিয়ার বলেন, “শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার যে মান ছিল সেটা গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় রক্ষা হয়নি। তাছাড়া ভোগান্তি লাঘব করার জন্য যে গুচ্ছের সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা ভোগান্তি না কমিয়ে বরং বাড়িয়েছে। গুচ্ছতে ভর্তি প্রক্রিয়া দীর্ঘ। প্রাথমিক ভর্তি, চূড়ান্ত ভর্তি, মাইগ্রেশেনে ভর্তি বাতিল করা, নম্বরপত্র উত্তোলনসহ নানা কারণে একজন শিক্ষার্থীকে এক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাধিক বার যেতে হচ্ছে। গুচ্ছের এ ব্যবস্থপনাটা অনেক জটিল। যা শিক্ষার্থীদের বুঝতেও সমস্যা হয়।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের অধ্যাপক আশরাফ উদ্দিন বলেন, “গুচ্ছের সবার জন্য কমন প্রশ্ন। এখানে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমাদের মত করে শিক্ষার্থীদের যাচাই করতে পারছি না। এতে তুলনামূলক কম মেধাবী শিক্ষার্থী পাচ্ছি। শাহজালালের ভর্তি পরীক্ষা যে মানের ছিল, গুচ্ছতে যাওয়ার কারণে সে মানের পরীক্ষাটা হচ্ছে না।”
এ শিক্ষকের দাবি, “গুচ্ছ প্রক্রিয়ায় মূলত নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো লাভবান হচ্ছে। গুচ্ছ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র অনেকটা গৎবাঁধা মুখস্তের ওপর নির্ভর। শিক্ষার্থীরা যেরকম গৎবাঁধা পড়া মুখস্ত করে এসএসসি ও এইচএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে যায়। কিন্তু প্রকৃত মেধাবী নয় বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পায় না। গুচ্ছ প্রক্রিয়া অনেকটা এরকমই। যেটা আমাদের নিজস্ব প্রশ্নপত্রে হত না। আমাদের প্রশ্নপত্রে প্রয়োগিক, বিশ্লেষণী দক্ষতা ও সৃজনশীল স্ট্যান্ডার্ড বজায় ছিল। এতে প্রকৃত মেধাবীদের বাছাই করা সহজ ছিল।”
গুচ্ছে ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যা্লয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, “শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি সভায় গুচ্ছ প্রক্রিয়া না থাকার পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সে সিদ্ধান্তের অফিসিয়াল নোটিশ আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে পোঁছে দিয়েছি। শিক্ষক সমিতি চায় না শাবিপ্রবি গুচ্ছে থেকে তার নিজস্ব স্বকীয়তা ও শিক্ষার মান বিপর্যয়ে নিয়ে যাক।”