চব্বিশের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন শুরু হয়েছিল চাকরিতে কোটা প্রথার সংস্কারের দাবিতে। বলা হয়েছিল এ আন্দোলন বৈষম্যের বিরুদ্ধে। বৈষম্য শুধু চাকরিতে মেধাবীদের হিস্যার হার হ্রাস-বৃদ্ধির কারণে ঘটছিল তা নয়, আর্থসামাজিক পরিবেশ পরিস্থিতিতে বৈষম্য সৃষ্টির বিভিন্ন উপায় উপাদান ও মাত্রা দিন দিন বাড়ছিল। শুধু কোটা ব্যবস্থাপনায় বৈষম্য দূরীকরণের দাবি মোকাবেলায় তৎকালীন সরকার এবং বিচার বিভাগ কর্তৃক যেভাবে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হচ্ছিল, যার সাথে ছিল রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি, তা ছিল দেশকে মেধাশূন্যকরণের তথা আর্থসামাজিক পরিবেশে বৈষম্য বৃদ্ধির দীর্ঘমেয়াদি সূক্ষ্ম পরিকল্পনার অংশ। এর বিপরীতেই ‘ঘুঘুর বারবার ধান খেয়ে যাওয়া’র বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে স্বল্প সময়ের নোটিশে ছাত্র-জনতার জেগে ওঠা শুধু নয়, দৃঢ়প্রত্যয়ে এক সাথে গর্জে উঠতে সময় লাগেনি। প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও ১৭ জন অশ্বারোহীর পদচারণার শব্দে শঙ্কিত লক্ষণ সেন যেভাবে পলায়ন করেছিলেন লক্ষ জনতার ঢাকাগামী যাত্রার মুখে আধাঘণ্টার মধ্যে অদম্য ‘অপ্রতিহত’ গতিতে চলা ক্ষমতাধর, সিন্ডিকেটেড স্বৈরাচার শক্তির স্মার্ট বাংলাদেশ থেকে আনস্মার্টলি প্রস্থান নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। মহীয়ান গরীয়ান সৃষ্টিকর্তার মেহেরবানিতে চৌকস নেপথ্য শক্তির দ্বারা এই পটপরিবর্তনের পথ পরিষ্কার এবং সাক্ষাৎ সংহার কাণ্ড থেকে ‘সোনার সাগরেদ’দের প্রশ্রয় দিতে জাতি এক অভিনব ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের’ পরিচয় প্রত্যক্ষ করে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ছাত্র-জনতার কাছে এই অকস্মাৎ পটপরিবর্তন-উত্তর পরিস্থিতি মোকাবেলা করার ‘নীলনকশা’ তো দূরের কথা সাদা কালো আঁকাজোকাও কারো সামনে ছিল না। ফলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থাপনার জন্য ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকারের ওপর দায়িত্ব অর্পিত হতেই হয়। ইদানীং আভাস ইঙ্গিত মিলছে, ‘অন্তর্বর্তীকালীন’ সরকার ক্ষমতা দখল করেছে এবং সেই সূত্রে ১৫ বছরের সব সমস্যার সমাধান তথা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তাদের দক্ষতা ও দায়িত্ববোধ প্রসঙ্গেও সমালোচনার সুর শোনা যাচ্ছে। উপলব্ধিতে এটাও আসছে যে, এই সরকারকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করে তাদের হটিয়ে ‘জনগণ’কে তাদের অধিকার আদায়ের ফোপর দালালির আভাস মিলছে। আর এসবের দায়দায়িত্ব চাপাতে তৎপর ঘরে-বাইরে অবস্থানরত নেপথ্য এমন এক শক্তি, যে শক্তির রোষানলে বরাবর বাংলাদেশ। তা এমন এক শক্তি যা কোনো রাষ্ট্র ও সরকারকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করতে তৎপর। Daron Acemoglu & James A. Rabinson, ‘Why Nations Fail, The Origins of Power, Prosperity and Poverty, (Profile Books, London, 2013) গ্রন্থে এমন কয়েকটি দেশের পরিস্থিতির প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন।
ঠিক এই প্রেক্ষাপটেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সে সময় বলেছিলেন, ‘এমন এক ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে হবে যেন ভবিষ্যতে আর কোনো স্বৈরাচার বা ফ্যাসিস্টতন্ত্র কায়েম না হতে পারে।’ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ফজরের ওয়াক্তেই অর্থাৎ ৫ আগস্টের বেলা ১টায় দেশবাসীকে জানানো হয়েছিল প্রস্তাবিত ইন্টেরিম সরকার গঠনে প্রধান রাজনৈতিক দলের (পতিত রাজনৈতিক দল ছাড়া) নেতৃবৃন্দকে গণভবনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতেই গঠিত হতে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এটি এই পটপরিবর্তনকে অতীতের পটপরিবর্তনসমূহ থেকে আলাদা এবং সম্ভাব্য সব ক্ষেত্রে ছাত্র-জনতার ইচ্ছার প্রতিফলন থাকার ইঙ্গিত বহন করে। এ সময় বিষয়টি বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল, আছে এখনো, ভবিষ্যতেও থাকবে। এ জন্য যে ১. এই সরকার পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া গঠিত হতে হয়েছে ২. এই সরকার এর একমাত্র সমর্থক সর্বস্তরের ছাত্র-জনতা ৩. এই সরকারের বিরূপ প্রতিপক্ষ পতিত সরকারের লক্ষ কোটি উচ্ছিষ্টভোগী, সুবিধাভোগী, দলীয় প্রশাসন ও বাহিনী, বিদেশী এজেন্ট, আইন বিভাগের বশংবদ বিরূপ পক্ষ, পটপরিবর্তনে সংক্ষুব্ধ এবং ভীত সন্ত্রস্ত সবাই ৪. এই সরকারকে ব্যর্থ করতে পারা মানে পতিতদের পুনর্বাসনে সহায়ক হওয়া, যে ভূমিকায় দেশীয় দালাল এবং বিদেশী বিশেষ বুদ্ধিদাতা, ইন্ধনদাতা, ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষ (যারা ব্রিটিশের বদান্যতায় বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯০৫-১৯১১) শুরু করে ১৯৪৭ এ ভারত ভাগ এবং পাকিস্তানি আমল (১৯৪৭-১৯৭১) পর্যন্ত প্রতিপক্ষ রাষ্ট্রকে অকার্যকরণে পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ ভূমিকায় ছিল) ৫. পতিত সরকার সুপরিকল্পিতভাবে প্রশাসন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংসে আত্মঘাতী পদক্ষেপের দ্বারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে ভূরাজনীতির ভায়রা ভাইদের কাছে লিজ দেয়ার পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছিল । সুতরাং গণহত্যায় লিপ্ত পরাজিত বাহিনী, দলীয় বাহিনী, প্রশাসন ও বিরাষ্ট্রীয়কৃত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের পরোক্ষ অসহযোগিতায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণসহ আইনশৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক কর্মতৎপরতার নাকাল পরিস্থিতি মোকাবেলায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যতিব্যস্ত রাখা হচ্ছে। শত সহস্র দাবি দাওয়া পেশ এবং শৃঙ্খলা ও জনচলাচল বিঘ্ন ঘটানোর সুযোগ নেয়া এটাও যেন সেই ষড়যন্ত্রের অংশ। বাইরের হুমকি ধমকি এবং বশংবদ ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার তো আছেই।
মানবাধিকার, আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠা; সিন্ডিকেটের কবল থেকে ব্যাংকিং ব্যবস্থা, ব্যবসা-বাণিজ্য, অবকাঠামো নির্মাণ সবই উদ্ধারকল্পে অন্তর্বর্তী সরকারকে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ স্বপ্নের বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে সংস্কার প্রস্তাব প্রেসক্রাইবের দায়িত্ব সর্বাগ্রে করণীয় হিসেবে অর্পিত হয়েছে। কেননা বিগত ১৫ বছর কিংবা তার আগে রাষ্ট্র এবং সরকারের মধ্যে আনুভূমিক ও ঊর্ধ্বমুখী সম্পর্ক ও শৃঙ্খলা ব্যাপকভাবে বিনষ্ট হয়েছে; একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠার পরে দলীয়করণের ফলে রাষ্ট্রীয় সংস্থার দায়িত্ব পালন বিপথগামী বা বিপর্যস্ত হয়েছে; জনপ্রশাসন ও বাহিনীর পেছনে রাজনৈতিক উৎকোচে ব্যয়বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন ধরনের বশংবদ বৈকল্য সৃষ্টি হয়েছে। পক্ষপাতদুষ্ট আইনের শাসন, জনস্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে অবজ্ঞা-অমনোযোগিতা, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাপনাকে দলীয় নির্বাচনের দ্বারা কলুষিত করায় সর্বত্র দায়িত্বশীলতায় ঘুণ ধরেছে, সর্বত্র দুর্নীতি পরিব্যাপ্ত হওয়ায় ভূমি প্রশাসন, জনসেবা পরিষেবা সমাজসেবা শোষণ ও শাসনের পর্যায়ে চলে গিয়েছে। মিডিয়া থেকে শুরু করে প্রায় সর্বত্র এক সেল্ফ সেনসরড পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে জন-আস্থায় চিড় ধরিয়েছে। সিন্ডিকেটেড শক্তি ও সমস্যা বাজার ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে অর্থনীতি, রাজনীতি ও রাষ্ট্রক্ষমতাকে কুক্ষিগতকরণের পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছে। অসমতার ভিত্তিতে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে নতজানুকরণের পথে চলে গেছে পররাষ্ট্রনীতি। ‘আয়না ঘরে’র মতো নারকীয় যন্ত্রণা, গুম, হত্যা ও অমানবিক কর্মকাণ্ড, ব্যাংক লুটসহ অর্থ পাচার সর্বোচ্চ পর্যায়ের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে দানবীয় যন্ত্রে পরিণত হয়েছে। সংবিধানকে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবাদর্শের গঠনতন্ত্রে পরিণত করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার সর্বোচ্চ পদধারীর দ্বারা সংখ্যালঘুদের জমি দখল, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান দখল ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে নির্যাতন নিবর্তন ও গণহত্যার চক্রান্তকারীরাই এনাম হিসেবে রাষ্ট্রের বড় বড় পদ দখল করে। তারা এমন সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়েছে যে, তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ব্যক্তিগত নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এতে জনমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে নিন্দিত হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশন খাওয়া কর্মকর্তাকে প্রশ্রয় দেয়ার প্রয়াসে দেশ ও জাতির মর্যাদা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
এসব অবস্থা থেকে প্রশাসন, বিভিন্ন বাহিনী, বিচারব্যবস্থাসহ সব নির্বাহী বিভাগকে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের স্বকীয়তা উদ্ধার, সংবিধানের সীমাবদ্ধতা দূর, আইনের শাসন ও মানবাধিকার পরিস্থিতির দুর্গতি দূর, সুশাসন, সদাচার ও জবাবদিহীকরণ ব্যবস্থার পুনর্বাসনকল্পে সংস্কার প্রস্তাব করে যাওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
এ কথা অবশ্যই ঠিক সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তাবে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকারের ওপর। সুতরাং সেই নির্বাচনের আগে সংস্কার প্রস্তাব এমনভাবে জনসমক্ষে তুলে ধরা বাঞ্ছনীয় হবে, যা বাস্তবায়নের জন্য জনগণ ভোটের মাধ্যমেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সরকার নির্বাচন করে তাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করতে পারে।
অতীতে, বিশেষ করে ১৯৯১ সালে এবং ২০০৯ সালে তদানীন্তন নির্বাচিত সরকারের কাছে তৎপূর্ববর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে সংরচিত সংস্কার প্রস্তাব ধোপে টেকেনি। বরং লক্ষণীয় হয়ে ওঠে যে, ২০০৮ সালের শেষে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী রাজনৈতিক দল তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে দেয়া প্রতিশ্রুতি (ন্যূনতমটি ছিল মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদ বিবরণী নেয়ার বিধান) পালন বা পূরণের ব্যাপারে উপেক্ষার পথ বেছে নিয়েছিল। বরং যেসব জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ইশতেহারে উল্লেখ না করেও (যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল, দলীয় নেতা ও পরিবারকে জাতীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠার প্রয়াস-প্রচেষ্টা, ট্রানজিট দেয়া, কুইক রেন্টাল, ব্যাংক দখল ইত্যাদি) একতরফাভাবে বাস্তবায়নে সচেষ্ট ছিল। ২০০৯ সালের সরকার বিজনেস কাউন্সিলের সুপারিশ চোখেও দেখেনি বরং রেগুলেটরি রিফর্ম কমিশনের প্রয়াস প্রচেষ্টা প্রতিবেদন বাতিল করে।
এসব কারণে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সামনে সংস্কার প্রস্তাব ও সুপারিশসমূহ উপেক্ষার সুযোগ না রাখাটাই হবে জনপ্রত্যাশার প্রতিফলন। সংস্কার প্রস্তাবসমূহ জনসমক্ষে প্রকাশ করে নতুন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী দলকে জনগণের সামনে প্রতিশ্রুতি আদায়ে সচেতন থাকা বাঞ্ছনীয় হবে। ভাবি সরকার গঠনে ইচ্ছুক সবাইকে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ বা জবাবদিহিতায় আনার এটাই হবে সম্ভাব্য সর্বোত্তম উপায়। এ সময় ও সুযোগ কেউ যেন ভিন্ন খাতে নিয়ে যেতে না পারে সেদিকে সবারই নিজ নিজ স্বার্থেই রাখতে হবে সজাগ দৃষ্টি।
লেখক : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান