মুফতি মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম:
ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো দান-সাদাকা। সাদাকা আরবি শব্দ অর্থ দান। ইসলামী পরিভাষায় দান করাকেই সাদাকা বলা হয়। সাদাকা শব্দটি সিদকুন শব্দ থেকে নিষ্পন্ন। অর্থ- সততা, যথার্থতা, শরয়ি পরিভাষায় আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সম্পদ ব্যয় করাকে সাদাকা বলা হয়। কেননা, মানুষ তার সর্বাপেক্ষা প্রিয় বস্তু এবং জীবন যাপনের প্রধান উপকরণ কষ্টার্জিত মাল ব্যয় করে এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আল্লাহ তায়ালার প্রতি ভালোবাসা এবং তার নির্দেশনাবলির প্রতি আনুগত্যের বাস্তব প্রমাণ দিয়ে থাকে বলে এই ব্যয়কে সাদাকা নামে অভিহিত করা হয়। কুরআন মাজিদে সাদাকা কথাটি সালাতের মতো ৮২ বার এসেছে, জাকাত শব্দটি এসেছে ৩২ বার, নামাজের সাথে এসেছে ২৬ বার, স্বতন্ত্রভাবে এসেছে চারবার, পবিত্রতা অর্থে এসেছে দুইবার। পবিত্র কুরআন মাজিদে ফরজ বা আবশ্যিক ও নফল এ উভয় প্রকার দানকেই সাদাকা বলা হয়েছে। তবে প্রচলিত অর্থে শুধু নফল দানকেই সাদাকা বলা হয়ে থাকে। ফরজ দান হলো- জাকাত, ফিতরা ও মান্নতের দান।
নফল সাদাকার প্রকারভেদ : সাদাকা দুই প্রকার- ১. সাধারণ সাদাকা ও ২. সাদাকায়ে জারিয়া।
সাধারণ সাদাকা : সাধারণ সাদাকা হলো গরিব-দুঃখীকে দান করা, দ্বীনি প্রতিষ্ঠানে দান করা, কাউকে সৎ পরামর্শ দেয়া, কাউকে ভালোবাসা ইত্যাদি।
সাদাকায়ে জারিয়া : মহানবী সা: বলেন, ‘সাদকায়ে জারিয়া তথা মৃত্যুর পরও যে আমলের সওয়াব স্থায়ী থাকে তা হলো- ১. সেই ইলম যা সে প্রচার-প্রসার করে গেছে; ২. নেক সন্তান; ৩. কুরআনের কপি; ৪. নির্মিত মসজিদ; ৫. নির্মিত মুসাফিরখানা; ৬. দান-সাদাকা, যা জীবিত অবস্থায় দান করা হয়েছে।
মহানবী সা: ওই ব্যক্তিকে সর্বাপেক্ষা বড় দাতা রূপে আখ্যায়িত করেছেন, যিনি পবিত্র কুরআন সুন্নাহর ইলম অন্যদের শিক্ষা দেন। এর পরের স্থান মসজিদ, মাদরাসা, এতিমখানা, রাস্তাঘাট নির্মাণ, পুকুর খনন প্রভৃতি কল্যাণকর কাজে দান করা। এ গুলো সাদাকায়ে জারিয়া বা স্থায়ী পুণ্য লাভের মাধ্যম।
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূলুল্লাহ সা: বলেন, ‘যখন কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করে তখন তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু তিনটি আমল বন্ধ হয় না- ১. সাদাকায়ে জারিয়া; ২. উপকারী জ্ঞান ও ৩. নেক সন্তানের দোয়া’ (শরহে মুসলিম-১১/৮৫)।
কুরআনে দানের নির্দেশ : আল্লাহ তায়ালা সব নবীকে ফরজ দান তথা জাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন- আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘আর আমি তাদেরকে (নবীদেরকে) নেতা বানিয়ে ছিলাম, তারা আমার নির্দেশ অনুসারে মানুষকে পথ প্রদর্শন করত এবং তাদেরকে প্রত্যাদেশ করেছিলাম সৎকর্ম করতে, সালাত কায়েম করতে এবং জাকাত প্রদান করতে আর তারা আমারই ইবাদত করত’ (সূরা আম্বিয়া-৭৩)।
আরো ইরশাদ করেন- ‘আর স্মরণ করো, যখন বনি ইসরাইল থেকে অঙ্গীকার নিয়েছিলাম যে, তোমরা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো ইবাদত করবে না, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, পিতৃহীন ও দরিদ্রদের প্রতি সদয় ব্যবহার করবে এবং মানুষের সাথে সদালাপ করবে, সালাত কায়েম করবে ও জাকাত দেবে’ (সূরা আল বাকারা-৮৩)।
অন্যত্র ইরশাদ করেন- ‘আমি তোমাদের সাথে আছি, যদি তোমরা সালাত কায়েম করো, জাকাত দাও, আমার রাসূলগণকে বিশ^াস করো ও তাদেরকে সম্মান করো এবং আল্লাহকে উত্তম ঋণ প্রদান করো’ (সূরা আল মায়িদা-১২)।
হজরত ঈসা আ: বলেন, ‘আর আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যতদিন জীবিত থাকি ততদিন সালাত ও জাকাত আদায় করতে’ (সূরা মারইয়াম-৩১)।
আরো ইরশাদ করেন- ‘সে (ইসমাইল) তাঁর পরিবারবর্গকে সালাত ও জাকাতের নির্দেশ দিতো এবং সে ছিল তাঁর প্রতিপালকের সন্তোষভাজন’ (সূরা মারইয়াম-৫৫)।
আল্লাহ তায়ালা বলেন- ‘তারা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, তারা কী ব্যয় করবে? (আল্লাহ বলেন) আপনি জানিয়ে দিন, যা তোমাদের প্রয়োজনাতিরিক্ত তা দান করো’ (সূরা বাকারা- ২১৯)।
আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন- ‘আর তাদের সম্পদে নির্দিষ্ট হক রয়েছে ভিক্ষুক ও বঞ্চিত সবার’ (সূরা মাআরিজ : ২৪-২৫)। আরো বলেন- ‘নিশ্চয়ই তোমাদের সম্পদে নিঃস্ব ও অসহায়দের অধিকার রয়েছে’ (সূরা আল আম্বিয়া-১৯)।
হাদিসে দানের নির্দেশ : রাসূল সা: বলেন, ‘মানুষ বলে আমার সম্পদ আমার সম্পদ অথচ তিনটি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সম্পদই শুধু তার- ১. যা খেয়ে শেষ হয়েছে; ২. যা পরিধান করে নষ্ট করেছে ও ৩. আর যা দান করেছে। আর অবশিষ্ট সম্পদ যা সে ছেড়ে যাবে, মানুষ তা শুধু নিয়ে যাবে’ (মুসলিম)।
হজরত আবু হুরায়রা রা: থেকে বর্ণিত- তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সা: বলেছেন, ‘প্রতিদিন সকালে দু’জন ফেরেশতা অবতরণ করেন। তাদের একজন দানকারীর জন্য এ দোয়া করেন, হে আল্লাহ দাতার মালে বিনিময় দান করুন তথা তার সম্পদ বাড়িয়ে দিন। আর দ্বিতীয়জন সব কৃপণের জন্য বদদোয়া করে বলেন, হে আল্লাহ কৃপণের মাল ধ্বংস করে দিন’ (বুখারি ও মুসলিম)।
রাসূল সা: বলেন, ‘হে কাব ইবনে উজরা! নামাজ আল্লাহর নৈকট্য দানকারী, রোজা ঢালস্বরূপ এবং দান-সাদাকা গুনাহ মিটিয়ে দেয়, যেমন- পানি আগুনকে নিভিয়ে ফেলে’ (আবু ইয়ালা)।
মহানবী সা: বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মসজিদ নির্মাণ করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতে অনুরূপ ঘর তৈরি করবেন’ (বুখারি-৪৫০)।
হজরত আয়েশা রা: থেকে বর্ণিত- রাসূল সা:-এর সময় একদা সূর্যগ্রহণ হলো, তখন রাসূলুল্লাহ সা: লোকদের নিয়ে সালাত আদায় করেন। অতঃপর তিনি লোকদের উদ্দেশে খুতবা দান করেন। প্রথমে তিনি আল্লাহর প্রশংসা করেন। অতঃপর বলেন, সূর্য ও চন্দ্র আল্লাহ তায়ালার নিদর্শনসমূহের মধ্যে দু’টি । কারো মৃত্যু বা জন্মের কারণে সূর্যগ্রহণ ও চন্দ্রগ্রহণ হয় না। কাজেই যখন তোমরা তা দেখবে তখন আল্লাহর কাছে দোয়া করবে, তার মাহাত্ম্য ঘোষণা করবে, সালাত আদায় করবে ও দান-সাদাকা করবে’ (বুখারি-১০৪৪)।
রাসূল সা: বলেন, ‘কিয়ামতের দিন সাত ব্যক্তি আরশের নিচে ছায়া লাভ করবে। তন্মধ্যে একজন হলো- যে এমনভাবে দান করে যে, তার ডান হাত কি দান করেছে বাম হাত তা জানে না’ (বুখারি ও মুসলিম)।
রাসূল সা: বলেন, ‘খেজুরের একটি টুকরা দান করে হলেও তোমরা জাহান্নামের আগুন থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা করো’ (বুখারি ও মুসলিম)।
রাসূল সা: আরো বলেছেন, ‘উপরের (দাতার) হাত নিচের (গ্রহীতার) হাত অপেক্ষা উত্তম’ (মুসলিম)।
যারা দান পাওয়ার হকদার : দান পাওয়ার হকদার আট শ্রেণীর মানুষ : ১. গরি- যার সামান্য পরিমাণ সম্পদ আছে কিন্তু তা দ্বারা তার সংসার চলে না; ২. মিসকিন- যার কিছুই নাই; ৩. জাকাত আদায়কারী; ৪. নওমুসলিমের জন্য (বর্তমানে এই বিধানটি রহিত হয়ে গেছে); ৫. দাস মুক্তির জন্য; ৬. ঋণগ্রস্তের জন্য; ৭. আল্লাহর রাস্তায় তথা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যয়ের জন্য; ৮. মুসাফিরকে; যে পথে নিঃস্ব হয়ে গেছে, যদিও দেশে তার অনেক সম্পদ রয়েছে (সূরা তাওবা-৬০)।