ইবনে নূরুল হুদা:
সুশাসনের অভাবই আমাদের সকল অর্জনকে ম্লান করে দিয়েছে। দেশের জনপ্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারবিভাগসহ রাষ্ট্রের প্রায় সকল সেক্টরেই দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচরিতার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে বিগত প্রায় ১৬ বছরের আওয়ামী-বাকশালীদের স্বৈরাচারি শাসনামলে দেশ অপশাসন-দুঃশাসনে পিষ্ট হয়েছে। রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ প্রতিষ্ঠানকে অভাবনীয় ও নির্লজ্জভাবে দলীয়করণ করা হয়। বাদ যায়নি রাষ্ট্রের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন এবং নির্বাচন কমিশনও। এসব সাংবিধান প্রতিষ্ঠান আওয়ামী শাসনামলে সরকারি দলের রাজনৈতিক কার্যালয়ে পরিণত করা হয়েছিল। দেশের গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধ্বংস করার জন্য জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি বাতিল এবং নির্বাচন কমিশনকে সাজানো হয়েছিল দলদাস ও ব্যক্তিত্বহীন ব্যক্তিদের দিয়ে।
দুর্নীতি দমন কমিশনকে ব্যবহার করা হয় সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করার জন্য। একই সাথে সরকারি দলের দুর্নীতিবাজদের দায়মুক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানকে। ফলে তা রীতিমত দায়মুক্তি কমিশনে পরিণত হয়। পাবলিক সার্ভিস কমিশনকে বানানো হয় আওয়ামী সার্ভিস কমিশনে। এই কমিশনের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের সরকারি চাকরিতে গণনিয়োগ দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। একইভাবে ড্রাইভার আবেদ আলীদের মাধ্যমে এই কমিশন দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের অভরণ্যে পরিণত করার অভিযোগ রয়েছে বেশ জোরালোভাবেই।
শিক্ষা প্রশাসনে শনির আছর পড়ে। নির্লজ্জভাবে দলীয়করণ করা হয় রাষ্ট্রের অতিগুরুত্বপূর্ণ এই সেক্টরকে। খোদ শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে নানাবিধ দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ভিসি ও অধ্যক্ষসহ দেশের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে তার বিরুদ্ধে ব্যাপক স্বেচ্ছাচারিতা ও অনিয়মের অভিযোগ ছিল খোদ আওয়ামী লীগের শাসনামলেই। মূলত সে সময়ের শিক্ষামন্ত্রীর মাধ্যমেই শিক্ষা প্রশাসনকে পুরোপুরি দলীয়করণ করে ফেলা হয়। শিক্ষা প্রশাসনের উচ্চ পদে অযোগ্য ও দলীয় বিবেচনা ব্যাপক পদায়ন করা হয়। ফলে পুরো শিক্ষা সেক্টরেই এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়; ভেঙে পড়ে শিক্ষা প্রশাসনের শৃঙ্খলা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার ঐতিহাসিক বিজয়ের মাধ্যমে দেশ স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ ও বাকশাল মুক্ত হয়েছে। যা ছিল দেশ ও জাতির এক ঐতিহাসিক অর্জন। নোবেল বিজয়ী ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। ক্ষমতা গ্রহণের সাথে সাথেই নতুন সরকার দেশকে স্বৈরাচারী আমলের রেখে যাওয়া জঞ্জালমুক্ত করার ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে শুরু করে। সংস্কার শুরু হয় রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে। সরকার শিক্ষা প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল শুরু করে। বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষ পদগুলোতে যোগ্য ও দলনিরপেক্ষ কর্মকর্তাদের পদায়ন শুরু হয়। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনের অস্থিরতা এতে কাটেনি। কারণ, সরকার দেশের শিক্ষা প্রশাসনকে পুরোপুরি স্বৈরাচারের প্রভাবমুক্ত করতে পারেনি। ফলে নিজ নিজ দপ্তরে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে রেষারেষিতে জড়িয়ে পড়ছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা।
এমতাবস্থায় শিক্ষা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য সম্প্রতি দু’টি দপ্তরের শীর্ষ চার কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। এর মধ্যে একজন প্রভাবশালী কর্মকর্তাও রয়েছেন। জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর বদলি বাণিজ্য, দপ্তরে দপ্তরে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন কিছু কর্মকর্তা। তারা ছাত্রজীবনে ছাত্রদল করেছেন এমন দাবি করলেও বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এদের সাথে পতিত স্বৈরাচারের যোগসূত্র রয়েছে বলে প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে। এ কারণে শিক্ষাবোর্ডসহ আরও কয়েকটি দপ্তরে ব্যাপক রদবদল হয়েছে। কিন্তু শিক্ষা প্রশাসনকে এখনো স্বৈরাচারের জঞ্জালমুক্ত করা সম্ভব হয়নি।
মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, আগের সরকারে থাকা কর্মকর্তাদের সরিয়ে বিভিন্ন দপ্তরের শীর্ষ পদে রদবদল করা হচ্ছে। কিন্তু বেশ কয়েকটি দপ্তরে নিজেদের মধ্যে রেষারেষি মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে। শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দু’টি দপ্তরের শীর্ষ চার কর্মকর্তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সবাই ৫ আগস্টের পর পদায়ন পেয়েছেন। এ ছাড়া যারা দুর্নীতি বা অদক্ষতার পরিচয় দেবেন তাদের ব্যাপারেও একই সিদ্ধান্ত আসবে। বিষয়টিকে রীতিমত ইতিবাচক হিসাবেই দেখা হচ্ছে। এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘যাদের বদলি করা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের নানা অভিযোগ রয়েছে। নতুন বাংলাদেশে আগের মতো করে প্রশাসন চালাবেন এমনটা হতে দেওয়া হবে না। সামনে আরও কঠোর সিদ্ধান্ত আসতে পারে’। জানা গেছে, আওয়ামী সরকারের পতনের পর শিক্ষা প্রশাসনের জাতীয়তাবাদী প্যানেল থেকে প্রথম পদায়ন হিসেবে পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) পরিচালক করা হয় প্রফেসর কাজী কাইয়ুম শিশিরকে। তিন মাস না যেতেই গত সম্প্রতি মযমনসিংহের মুমিনুন্নিসা সরকারি মহিলা কলেজে বদলি করা হয় ১৪তম বিসিএসের এই কর্মকর্তাকে। নিজ দপ্তরে আওয়ামী লীগের সময়ের কর্মকর্তাদের রক্ষা, আশ্রয়, অফিসার্স ক্লাবের সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে অশালীন আচরণ এবং প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের কারণে তাকে বদলি করা হয়েছে বলে জানা গেছে। শিক্ষা ক্যাডার ও নিজ দপ্তরে অর্থের বিনিময়ে পদায়ন করাতে একটি বলয় গড়ে তোলার চেষ্টা করছিলেন তিনি।
জানা গেছে, শিক্ষা ক্যাডারের প্রভাবশালী এই কর্মকর্তার সঙ্গে একই দপ্তরের যুগ্ম পরিচালকের দ্বন্দ্ব শুরু হয় দুই মাস আগে। শেখ হাসিনার পতনের একদিন আগে ৪ আগস্ট শিক্ষাভবনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে খুনি বলে স্লোগান দেন আওয়ামীপন্থী কিছু কর্মকর্তা। তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ডিআইএ-এর কর্মকর্তা। ডিআইএ-এর এই কর্মকর্তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হলেও পরবর্তীতে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ ছিল কাইয়ুম শিশিরের বিরুদ্ধে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের টাকা লেনদেন করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কাইয়ুম শিশিরের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ রয়েছে, অভিযুক্তদের মধ্যে ছয়জনকে তিনি আগলে রেখে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ পরিদর্শনে পাঠাচ্ছেন। এই নিয়েই মূলত দুজনের দ্বন্দ্ব শুরু। দেশের ১১টি সরকারি কলেজে নতুন অধ্যক্ষ এবং তিনটি কলেজে উপাধ্যক্ষ দিয়েছে সরকার।
আর ১১টি শিক্ষাবোর্ডে শিগগিরই আরও বড় ধরনের রদবদল হবে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে। ডিআইএ সূত্র বলছে, গেল সপ্তাহে ‘স্লোগান দেয়া’ ছয়জনকে বিভিন্ন অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে পাঠান পরিচালক। কিন্তু যুগ্ম পরিচালক তাদের পাঠাতে নিষেধ করেন। এ নিয়ে দ্বিতীয় দফায় দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এর মধ্যে কক্সবাজারে গিয়ে একটি টিম জনতার রোষানলে পড়ে। মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব বলেন, ডিআইএ-তে কে আধিপত্য ধরে রাখবেন তা নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হয় তাদের মধ্যে। অভ্যন্তরীণ অনেক সিদ্ধান্তের বিষয়ে তারা দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন। এই মুখোমুখি অবস্থান থেকে অধিদপ্তরকে রক্ষা করতে পরিচালককে বদলি করা হয়েছে।
সম্প্রতি পরিচালক কাইয়ুমকে ঢাকা অফিসার্স ক্লাবের সদস্যপদ থেকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অসদাচরণ, ক্লাবের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থতা ও গঠনতন্ত্রের বিধি লংঘন করায় তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় শিক্ষাপ্রশাসনে প্রভাবশালী কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগের ১৬ বছর তিনি ঢাকার বাইরে ছিলেন বেশি। সর্বশেষ কুড়িগ্রামের একটি কলেজে ছিলেন। আওয়ামী লীগ সরকার তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ তুলে বিভাগীয় মামলাসহ নানা হয়রানি করে।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, ৫ আগস্টের পর শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী পদে পদায়ন পান রায়হান বাদশা। তার সাথে প্রধান কার্যালয়ের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আফরোজা বেগম ও সমীর কুমার রজক দাসকে পদায়ন করা হয়। দুর্নীতি ও অদক্ষতার অভিযোগে এই তিনজনকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। সিলেটের অন্তত ১১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে রায়হান বাদশার বিরুদ্ধে। তিনি দুর্নীতি আড়াল করতে সিলেটের নির্বাহী পকৌশলীকে জোরপূর্বক অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে পাঠিয়েছেন বলেও অভিযোগ উঠেছিল। আর সমীর কুমার রজক দাসের বিরুদ্ধে নিয়মিত দপ্তরে না থাকা এবং নথিপত্র ও ড্রইং-ডিজাইন আটকে রেখে ঠিকাদারদের হয়রানি করার অভিযোগ রয়েছে।
এদিকে শিক্ষা প্রশাসনে শৃঙ্খলা ও স্বস্তি ফেরাতে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের কয়েকটি শাখায় বেশকিছু পদে পরিবর্তন আনা হয়েছে বলে জানা গেছে। মাউশির ওএসডিতে থাকা কাজী ফয়জুর রহমানকে বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক করা হয়েছে। আগের বিদ্যালয় পরিদর্শক আবুল মনছুর ভুঞাকে চট্টগ্রামে বদলি করা হয়েছে। মাধ্যমিকের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রফিকুল ইসলামকে রাজবাড়ীতে পাঠানো হয়েছে। তার স্থলে পদায়ন পেয়েছেন ঢাকা উদ্যান কলেজে সংযুক্ত জাকির হোসেন। কলেজ শাখার উপ-পরিদর্শক কল্যাণী নন্দীকে ওএসডি করে তার স্থলে পদায়ন করা হয়েছে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের ছানা উল্লাহকে। উপ-পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক জাকির হোসেনকে দিনাজপুর ফুলবাড়ী কলেজে বদলি করা হয়েছে। তার জায়গায় পদায়ন পেয়েছেন ইডেন মহিলা কলেজে এনসিটু থাকা নুরুল হক। প্রশাসন ও সংস্থাপন শাখার উপসচিব খান খলিলুর রহমানকে ফরিদপুরে পাঠানো হয়েছে। তার স্থলে পদায়ন পেয়েছেন ঢাকা আলিয়া মাদরাসার সহযোগী অধ্যাপক ইমদাদ জাহিদ। এনসিটিবির গবেষণা কর্মকর্তা রুবেল হোসাইনকে যশোর শিক্ষাবোর্ডের অডিট অফিসার হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। একই বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক নিয়ামত ইলাহীকে বদলি করা হয়েছে। যশোর বোর্ডের অডিট অফিসার খুরশিদ আলম মল্লিককে এক ধাপ পদোন্নতি দিয়ে একই বোর্ডে উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক করা হয়েছে।
সরকার দেশের শিক্ষা প্রশাসনে নৈরাজ্য ও অস্থিরতা বন্ধের জন্য ইতিবাচক তৎপরতা চালালেও এক্ষেত্রে তারা এখনো সফল হয়নি বরং স্বৈরাচার ও ফ্যাসিবাদের প্রতিভূরা এখনো শিক্ষা সেক্টরে বেশ তৎপর রয়েছে। ফলে শিক্ষা প্রশাসনে এখনো শৃঙ্খলা ফিরে আনা সম্ভব হয়নি। আর সে রেশ কাটতে না কাটতেই না কাটতেই চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। কথায় কথায় শিক্ষার্থীরা নেমে আসছেন সড়কে। ভাঙচুর, অবরোধ যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বিঘ্ন ঘটছে লেখাপড়ায়। এতে আতঙ্কিত হয়ে পড়ছেন সাধারণ শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে তা বড় আকার ধারণ করলেও সমস্যা সমাধানে দক্ষতার পরিচয় দিতে পারছেন না কলেজ অধ্যক্ষরা। সম্প্রতি ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার তিন কলেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠকে বসে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। শিক্ষার্থীদের ট্রমা কাটাতে প্রত্যেক কলেজে একটি করে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বৈঠকে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, তিন কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। প্রথমত শিক্ষার্থীরা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছেন। যৌক্তিক হোক আর অযৌক্তিক হোক কাউকে জিম্মি করে তাদের দাবি আদায় করতে চাচ্ছেন। দ্বিতীয় কারণ হিসেবে জানা যায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনকে কেন্দ্র করে স্বার্থান্বেষী কোনো মহল বা পতিত স্বৈরাচারের প্রতিভূরা ঢুকে পড়েছে। তারা শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝিয়ে ইন্ধন দেয়ার চেষ্টা করছে। এতে শিক্ষার্থীরা আরো বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ছেন। আর তৃতীয় কারণ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও প্রতিষ্ঠানপ্রধানরা তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছেন না। যেকোনো ইস্যুর প্রাথমিক অবস্থায় হস্তক্ষেপ করে তা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না কলেজ প্রশাসন। এ ছাড়া গত আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে আন্দোলনের মাধ্যমে স্কুল ও কলেজের প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করেন শিক্ষার্থীরা। এ ব্যাপারে বিবৃতি ছাড়া আর কোনো দায়িত্ব পালন করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আর মাউশি অধিদপ্তর ছিল একেবারেই নীরব। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা পৃথক বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে রাজধানীর রাজপথ অবরোধ করে একাধিকবার আন্দোলনে নামেন। সবচেয়ে কঠোর আন্দোলন করেন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা। তারা সড়ক অবরোধের পাশাপাশি রেলপথও অবরোধ করে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আইন প্রণয়নের প্রয়োজন রয়েছে, যা জাতীয় সংসদ কর্তৃক পাস হতে হয়। কিন্তু এখন দেশের সংসদ নেই। ফলে সরকার ইচ্ছা করলেও এখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই। যেসব শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে পড়ছেন ও আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত তারা যথেষ্ট জ্ঞানের অধিকারী। কিন্তু তাদের এই বিষয়টি বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে কলেজ প্রশাসন। সম্প্রতি রাজধানীর ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা বাসে ওঠাকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সংঘর্ষে জড়ালে সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও নিউ মার্কেট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সিটি কলেজ সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা হয়। শিক্ষার্থীদের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করতে পারেনি দুই কলেজের প্রশাসন।
সবশেষ ঘটনা গত রবি ও সোমবারের। পুরান ঢাকার ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের একজন শিক্ষার্থীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বড় সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থীরা অন্যান্য কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়ে গত রবিবার হাসপাতালে আক্রমণ চালান। এরপর তারা পাশেই অবস্থিত সোহরাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল কলেজে ব্যাপক ভাঙচুর করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার ওই দুই কলেজের শিক্ষার্থীরা মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজে ভাঙচুর করেন। এতে ডেমরা এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এ ক্ষেত্রে কোনো প্রতিষ্ঠান প্রধানরাই তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারেনি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী শক্তির পতন হলেও পতিত শক্তির প্রতিভূরা এখনো রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরে তৎপর রয়েছে। নতুন সরকার অনেক চেষ্টা করেও এদের সিন্ডিকেট ভাঙতে পারেনি। বিশেষ করে শিক্ষা প্রশাসনে এখন পর্যন্ত শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। সরকার দেশের শিক্ষা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানোর কথা বললেও ষড়যন্ত্রকারীদের খপ্পর থেকে মুক্ত হতে পারেনি। একই সাথে দেশের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো পরিকল্পিতভাবে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য পতিত স্বৈরাচারী অপশক্তি সর্বাত্মকভাবে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষা প্রশাসন ও শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য ঠেকাতে অন্তর্বর্তী সরকারকে কার্যকর ও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দেশের শিক্ষা সেক্টরকে স্বৈরাচারের অশুভ বৃত্ত থেকে মুক্ত করা যাবে না।