যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ পারস্পরিক আস্থা ও সম্মানবোধে কার্যসম্পাদন করে থাকে। তিনটি বিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ করার অর্থ হলো- এক বিভাগের কাজে অন্যটির কোনো রকম হস্তক্ষেপ না করা। বিশ্বের প্রায় সব দেশে বিচার বিভাগকে বলা হয় জনগণের শেষ ভরসাস্থল। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। তাই এখানে মানুষ আশাহত হলে নাগরিকদের প্রতিকার চাওয়ার কোনো জায়গা থাকে না।
পৃথিবীর প্রায় সব দেশে বিচার বিভাগ দুই ভাগে বিভক্ত। একটি উচ্চাদালত এবং অন্যটি অধস্তন আদালত। উচ্চাদালতের বিচারকরা সাংবিধানিক পদধারী। অধস্তন আদালতের বিচারকরা একই সাথে সংবিধানে বর্ণিত বিচার বিভাগীয় পদে দায়িত্ব পালনরত এবং সরকারি কর্মচারী। উচ্চাদালতের বিচারকদের নিয়োগ সাধারণত সংবিধান এবং এর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রণীত আইনের অধীন হয়ে থাকে।
ভারতীয় উপমহাদেশের দেশগুলোর মধ্যে দেশভাগ পরবর্তী ১৯৪৭ সাল থেকে এখনো একমাত্র ভারতে বাধাহীন গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা অনুসৃত হয়ে আসছে। ভারতের সংবিধান প্রণয়ন-পরবর্তী ক্ষমতাসীন দলের অভিপ্রায় অনুযায়ী উচ্চাদালতের বিচারকদের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত করতেন। গত শতকের নব্বই দশকের প্রথমার্ধ থেকে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট প্রদত্ত দু’টি রায়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ও জ্যেষ্ঠ অন্য চারজন বিচারপতি সমন্বয়ে গঠিত কলেজিয়াম বিচারপতিদের নিয়োগ চূড়ান্ত করে আসছে।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগে কলেজিয়াম হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং অন্যান্য বিচারপতিদের মধ্য থেকে নিয়োগ বিষয়টি চূড়ান্ত করে। হাইকোর্টের বিচারপতি নিয়োগে নিজ নিজ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং জ্যেষ্ঠতম দু’জন বিচারপতির প্রস্তুত করা সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কলেজিয়াম নিয়োগের কাজটি চূড়ান্ত করে।
ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং জ্যেষ্ঠতম অন্য চার বিচারপতি সমন্বয়ে যে কলেজিয়াম গঠিত তা বিচারিক সিদ্ধান্তের অনুবলে সৃষ্ট। দীর্ঘদিন ধরে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিচারক নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ করাসহ এ বিষয়ে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে নিয়োগসংক্রান্ত কমিশন গঠনে আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়ে আসছিল। সংবিধান সংশোধনে সংসদের মোট সদস্য সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের সমর্থনের আবশ্যকতা থাকায় এ নিয়ে কলেজিয়াম গঠন-পরবর্তী বিভিন্ন সরকার উদ্যোগ নিলেও প্রয়োজনীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে করতে পারেনি।
২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় জনআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে দলটির নেতৃত্বাধীন সরকার উচ্চাদালতের বিচারক নিয়োগ বিষয়ে স্বচ্ছতা আনতে ন্যাশনাল জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কমিশন (এনজেএসি) গঠনে আইন প্রণয়ন করে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনে। এটি ছিল ভারতের সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী।
এনজেএসি গঠন নিয়ে আইনটিতে বলা হয়- সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে উচ্চাদালতের বিচারকদের নিয়োগ বিষয়ে এটি একটি কমিশন। এই কমিশনের অপরাপর সদস্য হলেন- সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠতম দু’জন বিচারপতি, কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী এবং দু’জন বিশিষ্ট ব্যক্তি যারা প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও লোকসভায় বিরোধীদলীয় নেতার মনোনীত হবেন। এনজেএসি আইন প্রণয়ন-পরবর্তী এটি লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিপুল ভোটে গৃহীত হয়ে আইনে পরিণত হয়। আইন প্রণয়নের পাশাপাশি সংবিধানের সংশোধনীও কার্যকর করা হয়।
বিচারক নিয়োগ বিষয়ে ভারতের সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী এবং এনজেএসি আইন প্রণয়ন বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ ৪ : ১ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় সংশোধনী ও আইন প্রণয়নকে বাতিল ঘোষণা করে সিদ্ধান্ত দেয় যে, উচ্চাদালতের বিচারক নিয়োগের সিদ্ধান্ত আগেকার মতো কলেজিয়াম চূড়ান্ত করবে।
ভারতের মতো বাংলাদেশেও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শাসনামলে ২০০৮ সালে উচ্চাদালতের বিচারক নিয়োগ নিয়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অধ্যাদেশ প্রণয়ন করা হয়। কমিশন গঠন বিষয়ে বলা হয়- ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিশনের চেয়ারম্যান হবেন প্রধান বিচারপতি এবং সদস্যরা হলেন আইনমন্ত্রী, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠতম দু’জন বিচারক, অ্যাটর্নি জেনারেল, সংসদ নেতা মনোনীত একজন সংসদ সদস্য, সংসদের বিরোধী দলের নেতার মনোনীত একজন সংসদ সদস্য, সভাপতি-সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এবং সচিব-আইন মন্ত্রণালয়; যিনি কমিশনের সদস্যসচিব হিসেবেও কাজ করবেন।
এই অধ্যাদেশ প্রণয়ন-পরবর্তী এটি নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে উচ্চাদালতে রিট মামলা দায়ের করা হলে সেটি অগ্রাহ্য হয়। অধ্যাদেশটি প্রণয়নকালীন সংসদ না থাকায় কার্যত এটি সাত সদস্যবিশিষ্ট কমিশনে পরিণত হয়। ২০০৮ সালে সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে অধ্যাদেশটি আইনে পরিণত না করায় তা কার্যকারিতা হারায়। অধ্যাদেশটি কার্যকর থাকাকালীন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন শুধু একবার উচ্চাদালতের বিচারক নিয়োগের কার্য সমাধার সুযোগ পায়। সেবারের তালিকা থেকে কমিশনের সুপারিশ করা ছয়জনকে রাষ্ট্রপতি উচ্চাদালতের হাইকোর্ট বিভাগে বিচারক পদে নিয়োগ দেন। এই ছয়জনকে স্থায়ী করার প্রশ্ন দেখা দিলে আওয়ামী লীগ সরকার সে সময়কার আইন উপদেষ্টা হাসান আরিফ স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অদক্ষদের নিয়োগ দিয়েছেন, এ অভিযোগে পাঁচজনকে স্থায়ী করা থেকে বিরত থাকে।
সুপ্রিম জুডিশিয়াল কমিশন অধ্যাদেশটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ওই অধ্যাদেশে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির কোনো ভূমিকা রাখা হয়নি। অধ্যাদেশটির ৬নং ধারায় বলা ছিল- আপিল বিভাগের বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক এবং হাইকোর্ট বিভাগের অতিরিক্ত বিচারক পদে উপযুক্ত ব্যক্তিকে বাছাইয়ের উদ্দেশ্যে নামগুলোর প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে কমিশনে উপস্থাপন করা হবে। প্রতিটি শূন্য পদের বিপরীতে অন্যূন তিনটি এবং অনূর্ধ্ব পাঁচটি নাম প্রস্তাব করতে হবে।
উপরিউক্ত বিধান থেকে স্পষ্টত ধারণা পাওয়া যায়, অধ্যাদেশটিতে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে কার্যত প্রধান বিচারপতি ও সুপ্রিম কোর্টের অন্য দু’জন জ্যেষ্ঠ বিচারকের কোনো ভূমিকা ছিল না। তাদের মধ্যে কারোর স্বাধীনভাবে কোনো ব্যক্তিকে বিচারক পদে নিয়োগে বিবেচনার অবকাশ ছিল না, যদি না ওই ব্যক্তি মন্ত্রণালয়ের সুপারিশভুক্ত না হন।
যেকোনো পদে নিয়োগে পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত নীতিমালা হলো- যে পদে নিয়োগ দেয়া হবে ওই পদের নিম্ন পদধারী কোনো ব্যক্তি নিয়োগ কমিটিতে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হতে পারবেন না। কিন্তু উপরিউল্লিখিত তিন ধরনের নিয়োগে দেখা যায়, কমিশনের ৯ সদস্যের মধ্যে চারজন সদস্যের অবস্থান সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অবস্থানের চেয়ে নিম্নে। রাষ্ট্রের মানক্রমে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারকের অবস্থান ৭নং, হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকের অবস্থান ৮নং, সংসদ সদস্যের অবস্থান ১২নং এবং সরকারের সচিবের অবস্থান ১৬নং ক্রমিকে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, বিচার বিভাগ পৃথিবীর প্রতিটি দেশে জনগণের শেষ ভরসাস্থল হওয়ায় এবং উচ্চাদালতের অবস্থান আদালতগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ হওয়ায় জনগণ সবসময় প্রত্যাশা করে স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবীরা যেন উচ্চাদালতে বিচারক হিসেবে নিয়োগ পান। ভারতে বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়াটি যে স্বচ্ছ নয়, এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিচারক নিয়োগ বিষয়ে এনজেএসি গঠন বিষয়ে আইন প্রণয়নসহ সংবিধান সংশোধন করা হয়েছিল। সরকারের এ পদক্ষেপের প্রতি সে দেশের সাধারণ জনমানুষের যে সমর্থন ছিল তা সুপ্রিম কোর্টের সাংবিধানিক বেঞ্চের কমিশন ও সংবিধানের সংশোধনী বাতিল পরবর্তী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়। ভারতের এনজেএসির প্রতি দৃষ্টি নিবদ্ধ করলে দেখা যায়, ছয়-সদস্যবিশিষ্ট কমিশনের তিনজন বিচার বিভাগের অন্তর্ভুক্ত এবং বিশিষ্ট ব্যক্তি দু’জন প্রধানমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি ও লোকসভার বিরোধীদলীয় নেতার মনোনীত হওয়ায় সেখানে সরকারের একক আকাঙ্ক্ষা যে ফলপ্রসূ হবে না তা অনেকটা স্পষ্ট ছিল। তাই দেখা যায়, যেকোনো নিয়োগ বিষয়ে প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠতম অন্য দুই বিচারপতির সিদ্ধান্তের প্রাধান্য ছিল।
বাংলাদেশের সংবিধানের ৯৫নং অনুচ্ছেদে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ পাওয়ায় যেসব যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে তা হলো- তাকে বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, আইনজীবীর বেলায় সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে অন্যূন ১০ বছরকাল কার্য সম্পাদনের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় পদে অন্যূন ১০ বছর অধিষ্ঠিত থাকতে হবে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ পেতে আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা থাকতে হবে।
উপরিউক্ত যোগ্যতাগুলো পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, দুই শ্রেণীর ব্যক্তিকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগ পেতে যোগ্য করার ক্ষেত্রে যেকোনো নিয়োগে অনুপাত হবে সমানুপাতিক। কিন্তু ২০০১ সাল-পরবর্তী প্রতিটি নিয়োগে আইনজীবী ও বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের মধ্যে অনুপাত ছিল কোনোসময় ৭০ : ৩০ আবার কখনো ৮০ : ২০। দীর্ঘদিন ধরে বৈষম্যমূলকভাবে সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে সংবিধানের চেতনার উপেক্ষা ও অবজ্ঞায় আইনজীবীদের অনুক‚লে এবং অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রতিক‚লে নিয়োগকার্য যে সমাধা করা হয়ে চলছে এর আইনানুগ ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান অত্যাবশ্যক।
অধিকন্তু বিগত দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে অধস্তন আদালত থেকে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগের প্রতিটি ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনা প্রত্যক্ষ করা গেছে। এমনও দেখা গেছে, জ্যেষ্ঠ ৫৪ জন আবার জ্যেষ্ঠ ২০৫ জনকে অতিক্রম করে যথাক্রমে ৫৫নং ও ২০৬ নং ক্রমিকের কর্মকর্তাকে উচ্চাদালতে বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উপরিউক্ত দু’টিসহ এ ধরনের প্রতিটি জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনে নিয়োগবিষয়ক যে সারসংক্ষেপ রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়েছিল তাতে অবশ্যই ব্যাখ্যা সহকারে যুক্তি উপস্থাপন অত্যাবশ্যক ছিল যে, অতিক্রান্ত প্রতিটি কর্মকর্তার তুলনায় মেধা, দক্ষতা, যোগ্যতা ও সততার বিচারে ৫৫নং ও ২০৬নং ক্রমিকের কর্মকর্তাদ্বয়সহ অপরাপর কনিষ্ঠ যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা উৎকৃষ্ট গুণাবলির অধিকারী। এ ধরনের ব্যাখ্যা না থেকে থাকলে যেসব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার ন্যায্য অধিকার ক্ষুণ্ণ করে তাদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে এর প্রতিবিধান জরুরি। যথাযথ ও যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া একজন বিচারকের জ্যেষ্ঠতা ক্ষুণ্ণ করে তাকে তার ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দীর্ঘদিন ধরে অধস্তন আদালত থেকে উচ্চাদালতে বিচারক নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে যে বিপুলসংখ্যক বিচারককে হতাশায় নিমজ্জিত করে অবমাননাকর অসহনীয় পরিবেশে চাকরিতে রেখে অধস্তন বিচার বিভাগের শৃঙ্খলা বিনষ্ট করা হয়েছে; তা কখনো একটি দেশের বিচার বিভাগের মৌল কাঠামোর ভিত সুসংহতে সহায়ক নয়।
অতীতে অধস্তন আদালতের বিচারকদের জ্যেষ্ঠতার ক্রম রক্ষা করে ঢাকার জেলাজজ পদসহ আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব থেকে সচিব পর্যন্ত পদে, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার যা বর্তমানে রেজিস্ট্রার জেনারেল, আইজিআর এবং পুরাতন জেলাগুলোর জেলাজজ পদে পদায়ন করা হতো। বিগত দুই যুগের বেশি সময় ধরে জ্যেষ্ঠতার মান রক্ষা করে পদায়ন কার্য সমাধা না হওয়ায় অভ্যুত্থান অব্যবহিত আগের সরকারের সময়কালে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব পদায়নে সংশ্লিষ্ট বিচারকের রাজনৈতিক মতাদর্শ মুখ্য বিবেচিত হয়েছে।
বিচার বিভাগের নিম্নতম পদ সহকারী জজ। সহকারী জজরা অতীতে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হতেন। বর্তমানে সহকারী জজরা বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে আসছেন। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট নামে স্বতন্ত্র অস্তিত্ববিশিষ্ট কোনো পদ নেই। বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের মূল পদ সহকারী জজ বা সিনিয়র সহকারী জজ বা যুগ্ম জেলাজজ বা অতিরিক্ত জেলাজজ। সহকারী জজ নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণে একজন প্রার্থীর ন্যূনতম যে শিক্ষাগত যোগ্যতা প্রয়োজন তা হলো- মাধ্যমিক থেকে আইন বিষয়ে স্নাতক অথবা স্নাতক সম্মান অথবা এলএলএম পর্যন্ত সব পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন। উচ্চাদালতে বিচারক নিয়োগে যোগ্যতা বিষয়ে এখনো আইন প্রণীত না হলেও বিচার বিভাগের নিম্নতম পদের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণে ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারিত থাকায় এর নিম্নের শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন কোনো ব্যক্তির উচ্চাদালতে বিচারক পদে নিয়োগ পাওয়ার সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শের ভিত্তিতে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে এ নিয়োগ কার্য সমাধা হয় বিধায় নিয়োগবিষয়ক সারসংক্ষেপ প্রেরণকালে শিক্ষাগত যোগ্যতা যে সহকারী জজের নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণের নিম্নের নয়, এতদসংক্রান্ত প্রত্যয়ন জরুরি। কিন্তু বিগত দুই যুগের বেশি সময় ধরে এসব নিয়োগ প্রদানে রাজনৈতিক বিবেচনা মুখ্য হওয়ায় শিক্ষাগত যোগ্যতায় গুরুত্বারোপ করা হয়নি।
আমাদের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে অধস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের ওপর তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত যে নিয়ম তা হলো- উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্নরা নিম্নতর যোগ্যতাসম্পন্নদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ করবেন। তাই উচ্চাদালতের বিচারকদের অধস্তন আদালতের বিচারকদের চেয়ে উচ্চতর যোগ্যতাসম্পন্ন হওয়া অত্যাবশ্যক। ভারতসহ উন্নত বিশ্বের সব রাষ্ট্রে উচ্চাদালত ও অধস্তন আদালতের বিচারকদের জন্য যে যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে তা হলো- যথাক্রমে এলএলএম সর্বোচ্চ মান ও মধ্যম মান।
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগে ৯৫নং অনুচ্ছেদে উল্লিখিত যোগ্যতার অতিরিক্ত কোনো যোগ্যতার উল্লেখ নেই। প্রধান বিচারপতি এবং আপিল বিভাগের বিচারক নিয়োগে বিগত দুই যুগের বেশি সময় ধরে একাধিকবার রাজনৈতিক হীনউদ্দেশ্যে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের ঘটনা পরিলক্ষিত হয়েছে।
প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের বিচারক পদে নিয়োগ সম্পূর্ণভাবে নতুন নিয়োগ। উভয় নিয়োগে নতুনভাবে শপথ গ্রহণের আবশ্যকতা রয়েছে। এযাবৎকাল বাংলাদেশে কখনো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে কর্মরত নন এমন কোনো ব্যক্তিকে প্রধান বিচারপতি বা আপিল বিভাগের বিচারক পদে নিয়োগ দেয়া হয়নি; যদিও সংবিধানের ৯৫নং অনুচ্ছেদের বিধানাবলি সাপেক্ষে অনুরূপভাবে কর্মরত ছিলেন না এমন ব্যক্তিকে উভয় ক্ষেত্রে নিয়োগ সংবিধানে বারিত নয়।
বাংলাদেশ একটি এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র হওয়ায় এবং একক সুপ্রিম কোর্ট বিদ্যমান থাকায় এ আদালতে যারা আইন পেশায় নিয়োজিত তারা বিচারক পদে নিয়োগ লাভ-পরবর্তী বিচারকার্য পরিচালনা করেন। এ ক্ষেত্রে নিয়োগপ্রাপ্ত সবাই স্বাধীনভাবে বিচারকার্য পরিচালনায় স্বমর্যাদায় সমাসীন থাকতে পারবেন কি না সে প্রশ্নটির উদয় অমূলক নয়।
উচ্চাদালতের বিচারকরা কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত হলে কারা নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন সে বিষয়ে জনসাধারণের ধারণা পাওয়ার সুযোগ ঘটে। এ সুযোগে কোনো ধরনের নৈতিকস্খলন আছে এমন ব্যক্তির নিয়োগ পাওয়ার পথ অনেকটা রুদ্ধ হয়ে যায়। সুতরাং যেকোনো দেশের উচ্চাদালতের বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠতম বিচারকদের প্রাধান্য রেখে যদি কমিশন গঠন করা হয় সে ক্ষেত্রে নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ হলে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবী ছাড়া অন্য কারো নিয়োগ পাওয়ার আশঙ্কা ক্ষীণ। তাই বিচার বিভাগকে স্বমর্যাদায় সমাসীন দেখতে চাইলে জনআকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী স্বচ্ছ নিয়োগপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৎ, দক্ষ, যোগ্য ও মেধাবীদের নিয়োগের অন্য কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষক
E-mail : iktederahmed@yahoo.com